সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২

শহীদ স্মরণ: দক্ষিণ ভারতের ভগৎ সিং ভাক্কম আব্দুল কাদির

 

ভারতে আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বপ্রথম অভিযানকারী দক্ষিণ ভারতের ভগৎ সিং ভাক্কম আব্দুল কাদির-এর ফাঁসির ৮০ বছর পূর্তিতে ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসের এই অকুতোভয় বীর সেনানীকে স্মরণ করেছেন- সেখ কামারুল ইসলাম এবং উম্মে কুলসুম।(Remembrance of Indian Freedom Fighter of Azad Hind Fauz, Vakkom Abdul Khadir by Sk. Kamarul Islam & Umme Kulsum )







প্রিয় ভাপা , চিঠিটা পাঠাতে চেয়েছিলাম প্রায় দুই মাস আগে। কিন্তু আমার হৃদয় সেদিন অন্য কিছু চিন্তা দ্বারা সংযত ছিল। এখন আবার অনুপ্রাণিত। আমরা প্রায়শই আমাদের জীবনের যাত্রায় এমন পর্যায়ে আসি যেখানে আমাদের বিপদের মুখোমুখি হতে হয় এবং দুঃখ সহ্য করতে হয়। কখনও কখনও এই ধরনের বিপদ এবং দুঃখ সর্বশক্তিমান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা মাত্র। আমাদের খুব কঠিন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। এ অবস্থায় আল্লাহর কাছে অভিযোগ করার কোনো অধিকার আমাদের নেই। আমাদের অধ্যবসায় এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে আমাদের ধর্ম দয়াময় প্রভুর কাছ থেকে এসেছে। 

প্রিয় পিতা, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। পরম করুণাময় আল্লাহ আমাকে শান্তিময় এবং অবিচল হৃদয় দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন। আমার এবং আপনার এই অসহায়ত্বে কোনও বচসা বা হতাশা থাকা উচিত নয়। এখানে আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তুষ্টির জন্য আত্মত্যাগের উপলক্ষ্য। আমাকে যদি জীবন হারানোর দ্বারা পরীক্ষা করেন , তবে আল্লাহ আপনাকে সন্তান হারানোর ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করছেন। আল্লাহর কসম, আমি অধৈর্য নই। 

আমার মামলার রায় হয় ১ লা এপ্রিল। ভারতীয় দণ্ডবিধির অধীনে আমাকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল এবং তার পরে ফাঁসিতে ঝুলানোর দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল। একজন ইউরোপীয় বিশেষ বিচারক আনুষ্ঠানিকভাবে হাইকোর্টে আমাদের মামলা পর্যালোচনা করেছেন, নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখেছেন এবং মৃত্যুদণ্ড আরোপ করেছেন। এরপর আমাদের আইনজীবীদের তৈরি একটি পিটিশন ভাইসরয়ের কাছে পাঠানো হয়।

প্রিয় পিতা , আমি আপনাকে চিরতরে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমার বিনম্র মৃত্যু হবে কাল সকাল ছয়টার আগে। সাহসী হও! হ্যাঁ ! রমজানের ৭ তারিখ শুক্রবার ভোর পাঁচটা থেকে ছয়টার মধ্যে আমি মৃত্যুবরণ করবো। 

শ্রদ্ধেয় বাবা, স্নেহময়ী মা, প্রিয় ভাই ও বোন। তোমাদের বলার মত কোন সান্ত্বনামূলক শব্দ আমার কাছে নেই। আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আবার দেখা হবে রোজ মাহশারায়। আমার জন্য দুঃখ করবেন না। আমার জীবনের শেষ নাটক আর মাত্র কয়েক ঘন্টা দূরে। 

 অবিলম্বে তোমরা  যখন কোন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে জানবে যে, আমি কত সাহসিকতার সাথে, প্রফুল্লভাবে এবং শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলাম নিশ্চিতভাবে তখন তোমরা আনন্দ করতে ব্যর্থ হবে না। অবশ্যই গর্বিত হবে।

আমাকে এখন থামতে দাও।

আসসালামু আলাইকুম ।


আমার প্রিয় বনি, 

এখানে আমার শেষ যাত্রার শেষ কথা! আপনাকে আমার অবিরাম ভালবাসা এবং আপনার আন্তরিকতার জন্য আমার হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আপনার মূল্যবান গুণাবলী এবং মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমি আপনাকে যা বলব তা কেবল প্রশংসা করা হবে । তবুও আমি কিছু বলার জন্য দুঃখিত।

মনে করবেন না যে একটি ভয়াবহ বিপর্যয় আসছে। এটি পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া তুচ্ছ জিনিসগুলির মধ্যে একটি মাত্র। আপনার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অন্যান্য ঘটনার সাথে তুলনা করলে আমাদের মৃত্যু হল আমাদের বিনম্র আত্মত্যাগ। এটা ঠিক যেমন লেখা থেকে একটা শব্দ কেটে ফেলার মতো। 

আমাদের মৃত্যু আরও অনেকের জন্মের পথ সুগম করবে। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিসর্জন দেওয়া ভারতের অগণিত বীর, মহাপ্রাণ সন্তান ইতিমধ্যেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাদের তুলনায় আমরা পূর্ণিমার চাঁদের কাছে নিছকই মোমবাতি। 

 আমরা শুরুতেই আমাদের লক্ষ্যে ব্যর্থ হয়েছি। এটা শুধুই দুর্ভাগ্য যে আমরা কিছুই করতে পারিনি। আপনার ভোগান্তি এবং আমাদের মৃত্যু দেশের কোন উপকার করার একটি সুযোগ এবং একটি ভাল সময় হারিয়েছে তার জন্য অবশ্য আমি ভাগ্যকে অভিশাপ দিতে পারি না। 

আমরা কোন স্বার্থপরতা ছাড়াই আন্তরিকভাবে কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু প্রথম ধাপের কথা ভাবার আগেই আমরা ব্যর্থতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলাম। 

এটা কোন ব্যাপার না। আমাদের যথেষ্ট সাহস এবং সামনে প্রচুর সময় আছে। আমি নিশ্চিত যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী দল এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী দলের মধ্যে ফাইনাল খেলায় আমরাই গোল করব। স্বাধীন ভারতে মুক্ত মায়ের সন্তান হিসাবে আপনি মাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করতে পারবেন! এ সম্পর্কে আর আমার বিশেষ কিছু বলবার নেই। আমাদের জন্য চিন্তার দ্বারা আপনাকে আঘাত করতে দেবেন না। 

আমরা যে অঙ্গীকার নিয়েছি তা মনে রাখবেন। দ্বিধান্বিত না হয়ে দায়িত্ব পালন করুন। এটাই মানুষের কর্তব্য। একেই আমরা ধর্ম বলি। ব্যর্থতায় সাফল্যের শুরু। অশেষ শুভকামনা রইল। আমি বিশ্বাস করি যে আমি প্রায়শই যা বলেছি তা আপনি ভুলে যাবেন না।

 -কাদির স্বাক্ষর


উচ্চ মূল্যবোধ এবং অপরিমেয় দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো এই দুটি চিঠিকে ইতিহাসের কাছে পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষা ও স্মরণের উপকরণ হিসেবে জমা দেওয়ার পর পরদিন সকালে তিনি দৃঢ়তার সাথে ফাঁসির মঞ্চে চলে যান।

সেপ্টেম্বর ১০, ১৯৪৩ ভাক্কম আব্দুল কাদির কোনো দ্বিধা ছাড়াই ফাঁসির মঞ্চের দিকে সেদিন এগিয়ে যান । আগের রাতে বাবাকে ও সংগ্রাম সাথী আজাদ হিন্দ সেনানী বনিফেস পেরেইরা-র কাছে যে অগ্নিগর্ভ চিঠি অর্পণ করেছিলেন এবং তাতে তার সাগরের মতো বিখ্যাত তার অসীম দেশপ্রেমের রেখাগুলো ইতিহাসে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবুও এটি একটি দুঃখজনক দুর্দান্ত সত্য, যে ওয়াক্কাম আবদুল কাদির সম্পর্কে বা তার সাথে ফাঁসি হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কোনও ইতিহাস আজ  বিশেষ আর প্রচারিত হয় না। ওয়াক্কাম আব্দুল খাদেরের উপর মালায়ালমে একটি ছোট বইয়ের কথা শুনলেও কখনও হাতে পাইনি।  বইটি বাজারে এখন পাওয়া যায় কিনা তাও নিশ্চিত নই।

ভাক্কাম আব্দুল কাদিরের জীবন আজাদ হিন্দ ফৌজ  তথা ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি উত্তেজনাপূর্ণ অধ্যায়। তবুও সেই ঘটনাবহুল জীবনের ইতিহাস ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধার শাহাদাতের আশি বছর পরেও আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে। একটি জাতির উদ্দেশ্যকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার একটি চালিকা শক্তি হল সে জাতির ইতিহাস। যে মানবসমাজ তার ইতিহাসকে গুরুত্ব দেয় না তারা অপরিণত ও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা একটি জাতি। সে জাতি অচিরেই হারায় তার গৌরব। যে জাতি জানে না যে তারা কোন পথে এসেছিল তারা জানবে না কোন পথে তাদের যেতে হবে। এটা খুবই লজ্জার বিষয় যে ভাক্কম আব্দুল কাদির , যিনি আমাদের দেশের জন্য শহীদ হয়েছিলেন এমন একজন বিরল বীর সম্পর্কে জানার জন্য বিশেষ উপকরণ আজকের ইতিহাসের ছাত্রদের চারপাশে নেই। তাই তার ফাঁসির ৮০বছরে আমাদের এই কলম তুলে ধরা। দেশে লক্ষ লক্ষ ইতিহাসের শিক্ষক, গবেষক আছেন। অন্তত তাদের সম্মিলিত প্রয়োজন এই কাজের জন্য প্রস্তুত হওয়া। অন্তত তাদের নতুন প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে যে ওয়াকুম আবদুল কাদির ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অমর ও কিংবদন্তি অধ্যায়। ১৯৪৩-র ৯ সেপ্টেম্বর রাতে ফাঁসির যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর ভাক্কম আব্দুল কাদির তার বাবা ও বন্ধু বনিফেসকে দুটি চিঠি লেখেন। মালায়ালামে লেখা সম্পূর্ণ চিঠি দুটি প্রথমেই আমরা বাংলায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছি।

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য সদ্য গঠিত আইএনএ-র সর্বপ্রথম গোপন ভারত অভিযানের পাঁচ সদস্য দলের নেতৃত্বে ছিলেন ভাক্কম আব্দুল কাদির। এই গোপন অভিযানের জন্য ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৪২ রাত দশটার পরে ভাক্কাম কাদিরসহ পাঁচজন ব্যক্তি মালয়েশিয়ার পেনাং বন্দর থেকে একটি জাপানি সাবমেরিনে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তাদের মস্তিষ্কে সর্বদা জাগ্রত ছিল পেনাং-এর ইণ্ডিয়ান স্বরাজ ইনস্টিটিউট বা আইএসআইয়ের প্রধান ব্যারিস্টার এন. রাঘবন স্যারের বাণী- "আগুনে ঝাঁপ দেওয়া পতঙ্গের মতো নয়, প্রয়োজনে সাহসীর মতো প্রাণ উৎসর্গ করবে"।

১৮ই সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরুর ৯দিন ভয়ঙ্কর  সমুদ্রযাত্রায় অশেষ ত্যাগ, কষ্টসহ্য করার পর তারা কেরালার উপকূলে পৌঁছায়। কোঝিকোড়ের কাছে তানূরের সমুদ্রতীর থেকে প্রায় ৫ মাইল দূরে একটি রাবারের নৌকায় তাদের চাপিয়ে সমুদ্র পর্যবেক্ষণ ও ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজ শিকারের জন্য বেরোনো জাপানি সাবমেরিনটি ফিরে গেল। তারা তীরের দিকে পৌঁছাতে একপ্রকার সাঁতার কাটতে লাগলো। খাদ্যের অপ্রতুলতা, সমুদ্র যাত্রার ক্লান্তি, অসুস্থতা, পেট খারাপ, বমি, বিপদসঙ্কুল সমুদ্রযাত্রায় মুহুর্মুহু টেউয়ের আঘাত ইত্যাদি এবং সেজন্য ঔষধের প্রকোপে এই অভিযাত্রী দল শারীরিক ভাবে খানিকটা খারাপ অবস্থায় থাকলেও তারা মানসিক ভাবে দেশমুক্তির জন্য উদগ্রীব এবং সতেজ ছিল। ব্রিটিশদের যুদ্ধ জাহাজ এড়াতে সাবমেরিনটিকে বারবার গভীর সমুদ্রে ডুব দিতে হচ্ছিল। ফলে এই আজাদ হিন্দ সেনানীদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ছিল। 

বাল্যকাল

আবদুল খাদের ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের এক তাজা ​​ফুল। একজন চমৎকার গায়ক, শিল্প ও খেলাধুলায় অসাধারণ প্রতিভাবান, সপ্রভিত,  বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী কাদির শিক্ষাজীবনে স্কুলের নায়ক ছিলেন। 

'দক্ষিণ ভারতের ভগৎ সিং' ভাক্কম আব্দুল কাদিরের জন্ম ২৫শে মে ১৯১৭। চিরায়িনকিঝু তালুকের ডাক্কাম গ্রামে পিতা ভাভাকুঞ্জ ও মাতা উম্মাসালেমার এক দুষ্টমিষ্টি ছেলে। তিনি শৈশবে একটি স্থানীয় স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন এবং পরে শ্রী নারায়ণ গুরু দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শ্রী নারায়ণ ভিলাস হাই স্কুলে তার মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষাবস্থায় সে সময়ে ওয়াকাটে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কাদিরকে গভীরভাবে আহত করেছিল এবং কাদির ভাবতেন কীভাবে একটি তুচ্ছ স্ফুলিঙ্গ ধ্বংসের বীজ বপন করে সর্বনাশ ঘটাতে পারে। ছোটবেলায় রক্ষণশীলতা ও সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ছাত্র আব্দুল কাদির ছিলেন বিভিন্ন জাতের সকল শ্রেণীর মানুষের বন্ধু। শৈশবেই তিনি স্কুলে সবার কাছে সত্যিকার একজন নায়ক রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি ছিলেন এলাকার একজন নামকরা ফুটবলার। অন্যান্য খেলাধূলাতেও ছিলেন সমান পারদর্শী। তিনি যেমন একাধারে ভালো গান গাইতেন তেমনি আবার পারফরমিং আর্টেও ছিলেন দক্ষ। একই সময়ে, তিনি সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং তার দেশপ্রেমের উত্তেজনাপূর্ণ বিপ্লবী গানগুলো জনগনকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতো। একজন ছাত্র হিসাবে, কাদির সেই সময়ে চিরায়িংকিজ এবং এর আশেপাশে অনুষ্ঠিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সমস্ত সভায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩৮ সালে মেট্রিক পাশ করার আগেই রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের জনসভায় যোগ দেওয়া কাদিরের নিয়মিত রুটিন ছিল। সেই সময়ে যখন মহাত্মা গান্ধী কেরলে এসেছিলেন, যখন গান্ধীর ট্রেনটি কাটাকাভুর রেলস্টেশনে থামলে এলাকা ভ্রমণ করছিলেন, বিশাল জনতার মধ্যে থেকে কাদির সে সময় গান্ধীজীকে মালা পরিয়ে বরণ করেছিলেন এবং তার হাতে চুমু খেয়েছিলেন। একজন নবীন তরুণের এ ঘটনায় এলাকাবাসী সেদিন গর্বিত হয়েছিল। 

প্রবাসে

তখনকার দিনে কেরালার চিরায়িনকিঝু, কাডাক্বাত্তুর, ভাক্কাম, কিলিমানুর, আত্তাল, পারাভুর ইত্যাদি জায়গা থেকে কাজের সন্ধানে যুবকেরা মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি জায়গায় যেতেন। স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মা কাদিরকে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে চেয়েছিলেন তাকে পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্বের সমর্থক করে তুলতে। তাই কাদির 1938 সালে একুশে বছর বয়েসে কাজের সন্ধানে মালয়েশিয়ায় চলে গিয়েছিলেন। সেখানে কিছুদিন গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশল বিভাগে সার্ভেয়ার হিসেবে চাকরি করেন। কিন্তু বিপ্লবী কাদির  এভাবে বেশিদিন চলতে পারেন নি। মালয়েশিয়ায় কর্মী হিসেবে বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেননি তিনি। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা কাদিরের মনকে বরাবরই নাড়া দিয়েছে। মালয়ের অন্যান্য প্রবাসী অগ্রণী ভারতীয়দের সাথে যোগ দিয়ে ইণ্ডিয়ান ইণ্ডিপেন্ডেন্স লীগের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সেখানকার সমস্ত ভারতীয়দের সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ করে গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। পরে আইএনএ গঠন হলে তিনি ভারতের জাতীয় সেনাবাহিনীতে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথে নামেন।  এভাবেই খাদের পরবর্তীকালের সুভাষ চন্দ্র বসুর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে যোগ দেন।

রাসবিহারী বোস ২৮-৩০ মার্চ ১৯৪২-এ টোকিওতে প্রবাসী ভারতীয়দের একটি সম্মেলন আহ্বান করেন, যেখানে ইণ্ডিয়ান ইণ্ডিপেন্ডেন্স লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরবর্তীতে সিঙ্গাপুরে রাসবিহারীকে একটি জনসভার সভাপতিত্ব করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল যেখানে অল-মালয়ান ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের ঘোষণা হয়।  লীগের নেতৃত্বে ছিলেন নেদিয়াম রাঘবন। এই সম্মেলনে, রাসবিহারী ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সেনাবাহিনী গঠনের জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এপ্রিল ১৯৪২ তে- বিদাদরী রেজোলিউশনের মাধ্যমে ক্যাপ্টেন মোহন সিং আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী গঠনের ঘোষণা দেন। এই রেজ্যুলেশনে বলা হয়- "ভারতীয়রা জাত, সম্প্রদায় বা ধর্মের সমস্ত পার্থক্যের ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতা প্রত্যেক ভারতীয়ের জন্মগত অধিকার। স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে একটি ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হবে"। এই ঘোষণার পরপরই ৯ মে, সিং আইএনএ-র জন্য নিয়োগ শুরু করেন। ২২শে জুন ১৯৪২ তারিখে ব্যাঙ্কক ইণ্ডিয়ান ইণ্ডিপেন্ডেন্স লীগের দ্বিতীয় সম্মেলনে নেতাজীকে আমন্ত্রণ করে আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব অর্পণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ব্যাঙ্কক রেজ্যুলেশনে INAকে Indian Independence Leagueর অধীনে করা হয়। লীগ সেখানকার ভারতীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন খুঁজে পেয়েছিল;  আগস্টের শেষে এর সদস্য সংখ্যা এক লক্ষের কাছাকাছি বলে অনুমান করা হয়। এরই সঙ্গে লীগ স্থানীয় ভারতীয় জনগণের অবস্থার উন্নতির জন্যও প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। জাপানের আই-কিকান এবং লীগ, গোয়েন্দা ও বিদ্রোহমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য বেশ কিছু আইএনএ সৈন্য নিয়োগ করে এবং মালয় থেকে আসা বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করে। রাঘবনের নির্দেশনায় সিঙ্গাপুরে প্রতিষ্ঠা হয় স্বরাজ ইনস্টিটিউট। এই স্কুলগুলি থেকে স্নাতকদের সাবমেরিনে বা প্যারাশুটে ভারতে পাঠানো হত গোয়েন্দা কাজ, নাশকতা এবং নাশকতামূলক কার্যকলাপ শুরু করার জন্য।

আইএসআই-তে প্রশিক্ষণ-

পেনাংয়ে শুরু হওয়া স্বরাজ ইনস্টিটিউট-এ আত্মঘাতী দলে যোগ দিতে এগিয়ে এসেছিলেন হাজার হাজার দেশভিমানি ভারতীয়। তবে তীব্র সাক্ষাৎকার ও প্রশিক্ষণের পর প্রথম ব্যাচে নির্বাচিত হলেন মাত্র ৩৩ জন। এর থেকে ২০ জনকে চারটি দলের ভাগ করে পরে ভারতে গোপন অভিযানে পাঠানো হয় । আইএনএ সেন্যদের জন্য গঠন করা স্বরাজ ইনস্টিটিউটে কাদির একজন উজ্জ্বল যোদ্ধায় পরিনত হন এবং দলের কৌশলগত শাখার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। তার প্রশিক্ষণ শেষ করার পর, ভাক্কাম আবদুল কাদির সবচেয়ে সাহসী দলের মূল ইউনিট ডেথ স্কোয়াডে বিশেষ বিশিষ্টতা অর্জন করেন। ব্রিটিশ শাসন ভাঙতে গোপন অভিযানের জন্য আইএনএ নিযুক্ত পাঁচ সদস্যের দলের প্রধান হিসেবে ভারতে আসেন তিনি।

আইএনএ-র সর্বপ্রথম ভারত অভিযান-

জাপানি সাবমেরিনে ভারত মহাসাগরের জলের নীচে বিচরণকারী ৫ জন ভারতীয়র কাছে ১০ টাকার নোটে ৫০০ টাকা ছিল । মালয়েশিয়ায় দীর্ঘ প্রবাসের পর, কালিকটের কাছে তনুর উপকূলের দিকে তাদের লক্ষ্য স্থির ছিল। বহুদিন পর তারা তাদের প্রিয় মাতৃভূমির উপকূলের দিকে যাচ্ছিল তাই আনন্দে তাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সামুদ্রিক অসুস্থতার জন্য ঔষধ খেয়ে এবং ইউ বোটটি ব্রিটিশদের জাহাজ এড়াতে সমুদ্রে অনেক গভীরে বারবার ডুব দেয়া সত্ত্বেও ছেলেরা তখনও ভালো অবস্থায় ছিল।  সুইমিং পুলে তারা যে সামান্য প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন তা সাহায্য করেছিল, কিন্তু তারা ভারতীয় উপকূল ছেড়ে চলে যাওয়ার অনেক বছর হয়ে গেছে এবং পাঁচজনই অনিশ্চিত ছিল যে তারা উপকূলে পৌঁছে কী পরিস্থিতিতে পড়বে... 

ভারতীয় এই মুক্তিযোদ্ধাদের তখনকার দিনগুলি পুনরুদ্ধার করা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। এবং তাদের রেখে যাওয়া চিঠিপত্র, টুকরো টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জীবনের গল্প, আইআইএল থেকে আইএনএ-র বিবর্তন ইত্যাদি খুব সহজ নয় বরং তা বেশ কষ্টসাধ্য। আইএনএ-র একেবারে শুরুতে প্রথম একটি প্রশিক্ষিত দলের এই কর্মের, এই অভিযানের ভুলে যাওয়া গল্পটি যারা শুধুমাত্র নেতাজীর পরবর্তীকালের অভিযানগুলো পড়েছেন, শুনেছেন তাদের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে। কুমারন নায়ার, রাঘবন এবং কাদিরের মতো লোকদের গল্প অযত্নে পথের ধারে পড়ে থাকে কখনও সেভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানো হয় নি। অথচ তারা আইএনএ-র শুরুর দিনগুলোতে লক্ষ লক্ষ দেশপ্রেমিকের প্রেরোনাদাতা হিসেবে কাজ করেছিলেন। স্বাধীনতার ইতিহাসে তারা গৌরবজনক দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন। রাঘবনের উপদেশে কাদির ইণ্ডিয়ান ইণ্ডিপেন্ডেন্স লীগে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে তাকে যেতে দেখি পেনাং-এ ইণ্ডিয়ান স্বরাজ ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষণে।

 এন রাঘবন ৩রা আগষ্ট, ১৯৪২ পেনাংয়ের গ্রীন লাইন রোডে ফ্রি স্কুল বিল্ডিংয়ে (বর্তমানে রাষ্ট্রীয় জাদুঘর) হিন্দ স্বরাজ বিদ্যালয় (ভারতীয় স্বরাজ ইনস্টিটিউট) বা নাকানো গাক্কো নামে পরিচিত একটি স্কুলের দায়িত্বের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। গোয়েন্দাগিরি, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, ফটোগ্রাফি, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার এবং জরিপ করার জন্য ভারতীয় বংশোদ্ভূত লোকদের জন্য ক্র্যাশ কোর্স প্রদানের জন্য স্কুলটি গঠিত হয়েছিল। এর মাধ্যমে একটি পঞ্চম কলাম তৈরি করে ভারতে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল। রাঘবন তার স্বরাজ ইনস্টিটিউট শুরু করেছিলেন যেখানে তরুণ ভারতীয়দের গুপ্তচর নৈপুণ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যেমন চিঠি খোলা, ফোনে ট্যাপ করা, গোপন কালি তৈরি করা, নথি জাল করা ইত্যাদি। পাঠ্যক্রমে ইতিহাস, ভূগোল, বিপ্লব, জাতীয়তাবাদ, ব্রিটিশ অধিগ্রহণ, প্রাথমিক চিকিৎসা, শারীরিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয়  প্রশিক্ষক কেনেকো, দাল্লাল, আলগাপ্পান, রাঘবন, কানেকো এবং ইচিউন্না দ্বারা দেওয়া হয়েছিল।  টিপি কুমারন নায়ার ড্রিল প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করেছিলেন।

বলাই বাহুল্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘটে চলা এই পরিস্থিতিতে মালয় এবং রেঙ্গুনে ব্রিটিশদেরও চোখ-কান ছিল, কারণ কী ঘটছে তা তারাও বেশ কিছুটা জানত।

প্রশিক্ষণ শেষে জাপানি সেনানায়ক ইওয়াকুরোর সাহায্যে সাবমেরিন এবং স্থলপথে এই আইএসআই-র প্রথম ব্যাচকে ভারতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।  আনন্দন, কাদির, আব্দুল গনি, ইপেন এবং জর্জের সমন্বয়ে গঠিত প্রথম দলটি ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৪২-এ পেনাং থেকে যাত্রা শুরু করেছিল এবং কালিকটের কাছে তানুরের উদ্দেশ্যে তারা গন্তব্য স্থির করেছিল।  দ্বিতীয় দল বনিফিস, বর্ধন, ডিক্রুজ, মামেন এবং বালাকৃষ্ণান নায়ারসহ ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৯৪২-এ পেনাং ত্যাগ করে এবং গুজরাট উপকূলে ওখামাদির কাছে তাদের নামিয়ে দেওয়া হয়।

প্রথম ব্যাচের প্রথম দলটি নয় দিনের ভয়ঙ্কর এবং দুঃসাহসিক ডুবো অভিজ্ঞতা এবং কঠোর ত্যাগের পর তিনি মালাবারের তনুরের তীরে পৌঁছেছিলেন।  কাদিরকে বহনকারী সাবমেরিন এবং দলটি ২৭ তারিখ সন্ধ্যায় কালিকট উপকূলে পৌঁছেছিল।  উপকূলে টহলরত RAF প্লেনের কারণে সাবমেরিনটি তীরের কাছে ভীড়তে পারেনি। অপেক্ষা করে  ২৮ তারিখের ভোরের প্রথম দিকে তাদের তীরে দেখা যায়। উপকূলীয় তানূর শহরের মোপলারা পার্বনের কারনে তখন বহুলোক জেগেছিল ও সতর্ক ছিল। আব্দুল কাদির তার সঙ্গীসাথীসহ রাবারের ডিঙি করে তীরে এসে পৌঁছায়। তীরে নেমে আব্দুল কাদির মোপলা নেতাদের সাথে দেখা করলেন। তাদের দুই ভাইয়ের কাছ থেকে থাকার মতো একটি জায়গার নিশ্চয়তা পান। কাদির তাদের দুই ভাইকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিতে রাজি করার চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু রাতের বেলা গ্রামবাসীরা পেনাং থেকে আসা আইএনএ-র বিপ্লবীদের খবর কালিকট পুলিশকে দিয়ে দেয়। আইএনএ-র আইএসআই-র স্বল্পদৈর্ঘ্যের প্রশিক্ষণ শেষে প্রথম দুটি ব্যাচ সাবমেরিন দ্বারা পশ্চিম উপকূলে, পরের দুটি বার্মা সীমান্ত দিয়ে স্থলপথে পাঠানো হয়েছিল। এই চারটি দলের প্রত্যেককেই ওৎ পেতে থাকা ব্রিটিশরা গ্রেফতার করেছিল। কারন ব্রিটিশরা এদের ব্যাপারে সমস্ত জায়গায় খবর সংগ্রহের জন্য লোক ছেড়ে রাখতো।

বিচার

দলের সঙ্গে আব্দুল কাদির অবিলম্বে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন এবং পরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তাকে মাদ্রাজের সেন্ট জর্জ ফোর্ট জেলে বন্দী করেন।  একটি সামরিক আদালত তাদের বিচার করে এবং তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর দণ্ডাদেশ দেয়।  তাই ১৯৪৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর কাদির ও তার দলকে ফাঁসি দেওয়া হয়।  ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপালী নক্ষত্রের মতো জ্বলে ওঠা ভাক্কাম কাদির দেশপ্রেমের গর্বিত উদাহরণ হিসেবে ভারতের মানুষের স্মৃতিতে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। 

ধরা পরার আট দিন পর আটই অক্টোবর তাদের হাত-পা শিকলে বেঁধে বিশেষ ট্রেনে করে মাদ্রাজে আনা হয়। ধৃত অন্যান্য আইএনএস-র সেনানীদেরও মাদ্রাজের সেন্ট জর্জ ফোর্টে নিয়ে আসা হয়।  অন্ধকার, নির্জন কারাগারে অবর্ণনীয় অবস্থায় তাদের রাখা হয়েছিল। সারাদিনের মধ্যে শুধুমাত্র সকালে একবারই দরজা খুলতো টয়লেটে যাওয়ার জন্য। আশ্চর্যের বিষয় হল যে, সুইসাইড স্কোয়াডের ৪ গ্রুপের ২০ সদস্যকে ভারতের বিভিন্ন অংশে আটক করে সেন্ট জর্জ ফোর্টে একই জায়গায় বন্দি করে রাখা হয়েছিলো। আইএনএ কয়েদিদের সেন্ট জর্জ ফোর্ট থেকে সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয় ১৭ই জানুয়ারি, ১৯৪৩ সালে। এই কারাগারটি 'মাদ্রাস পেনিটন শেরি' নামে পরিচিত ছিল। আইএনএ কয়েদিরা 'আমাদের মুক্তি দাও অথবা বিচারের মুখোমুখি করো' এর দাবিতে সেখানে অনশন শুরু করে। ব্রিটিশ সরকার দ্বারা গুপ্তচরবৃত্তি ও নাশকতামূলক মামলা মোকাবিলার জন্য জারি করা শত্রু এজেন্টস অর্ডিন্যান্স নং ১,  সেপ্টেম্বর ০২, ১৯৩৯ থেকে কার্যকর হয়। এই আইন অনুযায়ী গঠিত বিশেষ আদালতে গোপনভাবে তাদের বিচার চলতে থাকে। 

১৯৪৩ সালের এপ্রিলে মাদ্রাজে তাদের প্রথম বিচারের তত্ত্বাবধানে ছিলেন বিচারক এলমার ই ম্যাক। কাদিরের দলের একজন কারাগারে ব্রিটিশদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন এবং পুরো অপারেশনের সম্পূর্ণ বিবরণ ব্রিটিশদের সরবরাহ করেছিলেন।  সে ছিল তেলিচেরি থেকে কেপি বালাকৃষ্ণান নায়ার (বালন) নামে মালাবার বাসিন্দা যিনি ২য় দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি রাজসাক্ষী হওয়ার জন্য ৬ই জানুয়ারী ১৯৪৩ কালিকট আদালতে ছাড় পান। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমা পেয়েছিলেন। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে তার দলের ৩৩ জন সাথীর নাম ঘোষণা করেছিলেন এবং রাঘবনের আইএসআই-র সম্পূর্ণ কাজের রূপরেখা তাদের জানিয়ে দেন।  তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি তার আসল নাম বলেছিলেন।  বালান ব্রিটিশদেরকে  আইএসআই, পেনাংয়ে কাটানো দিনগুলি এবং প্রশিক্ষণের ২৭ দিনের একটি স্পষ্ট বিবরণ দিয়েছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের জানান যে, তাদের বিভিন্ন দলে ভাগ করার পরে, তাদেরকে টাইপলিখিত নির্দেশাবলী এবং অর্থ দেওয়া হয়েছিল।  তাদের বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের গতিবিধি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার এবং মীনাক্ষী মন্দির বা তাজমহলের মতো পূর্বনির্ধারিত স্থানে তাদের অংশীদারদের সাথে দেখা করার নির্দেশ ছিলো। বালান অন্য সবাইকে জানত এবং সে তার স্বীকারোক্তিতে তাদের সকলের সমস্ত বিবরণ দিয়েছিল। 

চাকরীর সন্ধানে মালয় পাঠানোর সাড়ে চার বছর পর ছেলেকে দেখতে মাদ্রাজ সেন্ট্রাল কারাগারে আব্দুল কাদিরের বাবা পৌঁছালে, কান্নায় ফেটে পড়া বাবার প্রতি তিনি সদর্পে বললেন, 'মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যে কোন আত্মত্যাগ করতে আমি প্রস্তুত; আমি কখনোই ইংরেজদের দাসত্ব চাই না'  । ৮ মার্চ কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি হল সেদিন গোপন আদালত হয়ে ওঠে। অভিযুক্তদের পক্ষে উপস্থিত হলেন বিশিষ্ট আইনজীবীরা। আদালত রায় দিয়েছে যে ভক্কাম কাদির, অনন্তন নায়ার, বর্ধন, বনিফিস এবং ফৌজা সিংকে দোষী সাব্যক্ত করে। সেসময় ভারতে পাশ হওয়া শত্রু অস্ত্র আইনের আইপিসি ১২১এ ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কঠিন কারাদণ্ডের পর তাদের ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিলো। শুধুমাত্র ১৯৪৬ সালের জানুয়ারিতে অপরাধ প্রমাণ করতে না পারা অন্য আসামীরা মুক্তি পায়। 

নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও কাদির আইএনএ-এর গোপনীয়তা প্রকাশ করেননি। এক বছরের কারাদণ্ড পূর্ণ করার পর, ভাক্কম আবদুল কাদিরকে ব্রিটিশ সামরিক আদালত বিচার করে এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়। তাই ১৯৪৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ওয়াক্কাম আবদুল কাদির এবং তার দলকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। পরে মামলাটি আপিলের জন্য যায়, যেখানে ভি রাজাগোপালচারী কাদিরের পক্ষে যুক্তি দেন। আপিলটি ভিত্তিহীন হওয়ায় প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং গভর্নর জেনারেলের কাছে আরও একটি আপিলও ব্যর্থ হয়। দোষী পাঁচজনকে ১৯৪৩ সালের ১০সেপ্টেম্বর ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।

এমন পারিস্থিতিতে যেখানে ইচ্ছা করলে সুপারিশ এবং ক্ষমার আবেদনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি পাওয়া যেতে পারতো। কিন্তু সাহসী মানুষটিকে যখন ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৬ বছর। ১৯৪৩ সালের ২১শে অক্টোবর স্টেটসম্যান রিপোর্ট করে যে অনুপ্রবেশকারী জাপ এজেন্টরা তানুরের গ্রামবাসীদের দ্বারা ব্যর্থ হয়েছিল। এর পরে স্বরাষ্ট্র সচিব জেএ থর্নকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তিনি কিছু অস্পষ্ট উত্তর দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। 

 ১৯৪৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে কাদির দুটি চিঠি লিখেছিলেন। তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু বনিফিসের জন্য একটি। অন্যটি পরিবারের জন্য। বনিফেসকে দেওয়া চিঠিটি দুজনের ঘরের মধ্যকার ময়লার একটি গর্তের মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়।

চিঠিটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে ভাক্কম আব্দুল কাদির মাতৃভূমির প্রিয় পুত্র, একজন সাহসী বিপ্লবী, একজন আশাবাদী, একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, একজন দার্শনিক এবং একজন কাব্যিক হৃদয়ের অসাধারণ মানুষ ছিলেন যিনি তার মৃত্যুর কাছে কখনও মাথা নত করেন নি। মাত্র ২৬ বছর বয়সী এই সাহসী দেশপ্রেমিককে ফাঁসির আগে ইংরেজরা  তার শেষ ইচ্ছার কথা জিজ্ঞেস করলে আব্দুল কাদির দাবি করলেন, 'হিন্দু-মুসলিম জোটের প্রতীক হিসেবে আমার সাথে একজন হিন্দু বিপ্লবীকে ফাঁসি দেওয়া হোক।" এভাবে কাদির ও অনন্তন নায়ারকে একই মঞ্চে একই সময়ে পাশাপাশি প্রথমে ফাঁসি দেওয়া হয় । এরপর ২৪ বছর বয়সী ফৌজা সিং নামের পাঞ্জাবী যুবক এবং সত্যেন্দ্র চন্দ্র বর্ধণ নামের ২৬ বছর বয়সী বাঙালি যুবককে একসাথে ফাঁসি দেওয়া হয়। হাসিমুখে ফাঁসির দিকে হাঁটতে গিয়ে মুখরিত হয়ে ওঠে জেলের ভিতর তাদের স্লোগান- 'ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক'। সেপ্টেম্বর ১০, ১৯৪৩ রমজান মাসের সপ্তম দিন শুক্রবার শহীদ হন সেই বীর দেশপ্রেমিকরা ।


আব্দুল কাদিরের ফাঁসির এক মাস পর চিঠি পেলেন তার বাপ্পা।




২৮শে নভেম্বর ২০২২ তৃতীয় বর্ষ ১৮তম সংখ্যা